সামাজিক চিন্তার আঙ্গিকে দুর্গা পূজা
দুর্গাপূজার হাল-হকিকত
দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাব সুদুরপ্রসারী। এই উৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ মিলনের উৎসব; নারী ক্ষমতার উন্নতি সাধনের প্রতীক; নতুন করে চেনার উৎসব; নতুন করে প্রেমে পড়ার উৎসব। আপামর বাঙালি এই উৎসবে মেতে ওঠার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে।
আধুনিক বাংলার দুর্গাপূজার ইতিহাস
কথিত আছে বাংলায় দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল পনেরশো খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে মালদা জেলায় কিছু জমিদারের হাত ধরে। আবার আরেকটি মতবাদ প্রচলিত যে নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার অথবা তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ন ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে এই পুজো প্রচলন করেন। এই বাংলায় বারোয়ারি পুজো প্রথম শুরু হয় হুগলির গুপ্তিপাড়া তে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে। এই বারোয়ারি পুজো কলকাতাতে নিয়ে আসেন কাশিম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এই পুজো তাঁর মুর্শিদাবাদের বাড়িতে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই শুরু হয়। তবে এই বারোয়ারি পুজো ‘সর্বজনীন’ পুজো র রূপ নেয় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে, যখন সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা এই পুজো র আয়োজন করেন বাগবাজারে সম্পূর্ণ জনগণের পরিচালনায় এবং উৎসাহে। এখন কলকাতায় যত পুজো অনুষ্ঠিত হয় সবই প্রায় সাধারণ জনগণের পরিচালনায়।
আজকের প্রচলিত দুর্গাপ্রতিমা র (একচালা) গঠনের নেপথ্যে ছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। একটু
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখনকার প্রচলিত দুর্গা কাঠামোর মতো পুজো প্রথা ভারতে আর কোন জায়গাতে নেই। সেখানে দেবী একাই পূজিত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত নিপুণতায় এই পুজোর সাথে যেমন আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তেমনই খেয়াল রেখেছিলেন প্রকৃতি উপাসনার প্রতি। দুর্গাপুজো কে সকল শ্রেণীর মানুষের মিলন উৎসবে পরিণত করবার প্রতি তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
কিছু কিছু আচার উপাচারের মাধ্যমে আমরা এদিকের কিছুটা হলেও সম্যক ধারণা পাই।
যেমন ধরা যাক মূর্তি তৈরীর উপকরণ: - মূর্তি তৈরির প্রধান উপকরণ এর (গোবর, গোমূত্র, গঙ্গামাটি, পুণ্য মাটি) অন্যতম পুণ্য মাটি যেটার উৎস স্থল ‘নিষিদ্ধ পল্লী’। প্রধান পুরোহিত কে বারবার ভিক্ষার মাধ্যমে এই মাটি নিয়ে আসতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এর বিরূপ মত পোষণ করলেও, হতেই পারে, এর মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষকে মিলিত করে, এই পুজোকে মিলন মালায় উপস্থাপিত করবার একটি নতুন প্রচেষ্টা। দুর্গাপূজা শুধুমাত্র দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই নয়, দুর্গা পুজো র আরেকটি দিক হল প্রকৃতির আবাহন। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কি নিপুণতার সাথে সব কিছুকে একটি সূত্রে গাঁথা হয়েছে। দেবী দুর্গা মহাবিশ্বের সমস্ত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম এবং সকল প্রাণীকুলের জন্মদাত্রী, এবং জীবনের রক্ষক। গাছপালা, প্রাণী, পাখি, মাছ, মানুষ সবাই তাঁর সন্তান এবং তিনি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সব রসদ সরবরাহ করেন। তিনি আমাদের অন্ন প্রদান করেন - তাই তিনি অন্নপূর্ণা। তিনি গাছপালা রক্ষা করেন অতএব তিনি হলেন শাকম্ভরী, যার শরীর থেকে জীবন ধারন কারী উদ্ভিদ জন্মায়। পুরান এবং বেদে দেবী দুর্গাকে বনদেবী বলে অভিহিত করা হয়েছে। এমনকি দুর্গার পূজার প্রচলিত নীতিতেও বারেবারে আমরা প্রকৃতির উল্লেখ পাই। দুর্গা ঠাকুর এর গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের যেটার সাথে সুর্যের একমাত্র তুলনা হয়; যার স্পর্শে সবকিছু অশুভ দূরে চলে যায় । অন্যভাবে দেখলে এই রঙ আমাদের সোনার বাংলার ফসলের প্রতিচ্ছবি। যেটা স্বচ্ছলতা, সমৃদ্ধি এবং অর্থের ইঙ্গিত বহন করে।